ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল? খালি পেটে সুগার লেভেল নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ গাইড

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
By -
0
ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল খালি পেটে সুগার লেভেল নির্ণয় চিকিৎসা ও প্রতিরোধ গাইডdiabetes-sugar-level-normal-guide-bangla (1)
আমাদের প্রত্যেকেরই জানা প্রয়োজন—ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল থাকে

ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতা কেন জরুরি?

বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিস  আমাদের অনেকের কাছেই একটি পরিচিত নাম, যা বিশ্বব্যাপী এক নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এটি এমন একটি বিপাকজনিত রোগ, যেখানে আমাদের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের ঘাটতির কারণে রক্তে গ্লুকোজের (চিনি) পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যায়। যদি সময়মতো এটি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, চোখ, হৃদযন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই, আমাদের প্রত্যেকেরই জানা প্রয়োজন—ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল থাকে, কখন চিন্তার কারণ এবং কখন সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি। আসুন, এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিই।

ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল — আসুন জানি বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড

ডায়াবেটিস বা রক্তে শর্করার মাত্রা বোঝার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড রয়েছে। এগুলি জানলে আমরা নিজেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আরও সচেতন হতে পারব।

১. খালি পেটে (Fasting) ব্লাড সুগার লেভেল কত হলে নরমাল?

খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা বা Fasting Blood Sugar (FBS) বলতে বোঝায়, অন্তত ৮ ঘণ্টা কিছু না খেয়ে থাকার পর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ।

  • নরমাল বা স্বাভাবিক মাত্রা: ৭০ - ৯৯ mg/dL
  • প্রি-ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা): ১০০ - ১২৫ mg/dL
  • ডায়াবেটিস: ১২৬ mg/dL বা তার বেশি

যদি আপনার খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা বারবার ১২৬ mg/dL বা তার বেশি আসে, তবে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

২. খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর (Postprandial) সুগার কত হওয়া উচিত?

খাবার গ্রহণ করার ঠিক ২ ঘণ্টা পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করলে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তাকে Postprandial Sugar বলে।

  • নরমাল বা স্বাভাবিক মাত্রা: ১৪০ mg/dL এর নিচে
  • প্রি-ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা): ১৪০ – ১৯৯ mg/dL
  • ডায়াবেটিস: ২০০ mg/dL বা তার বেশি

যদি খাবার পর আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা ২০০ mg/dL ছাড়িয়ে যায়, তবে এটি ডায়াবেটিসের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত হতে পারে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

৩. HbA1c টেস্টে রক্তের গ্লুকোজের আদর্শ মাত্রা কত?

এই পরীক্ষাটি বেশ নির্ভরযোগ্য, কারণ এটি গত ২ থেকে ৩ মাসের রক্তে শর্করার গড় মাত্রা পরিমাপ করে।

  • নরমাল বা স্বাভাবিক মাত্রা: ৫.৭% এর কম
  • প্রি-ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা): ৫.৭% – ৬.৪%
  • ডায়াবেটিস: ৬.৫% বা তার বেশি

HbA1c টেস্ট ডায়াবেটিস নির্ণয় এবং এটি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি।

৪. রক্তে সুগারের স্বাভাবিক রেঞ্জ – এক নজরে (চার্ট)

আসুন, একটি চার্টের মাধ্যমে রক্তে সুগারের বিভিন্ন মাত্রা সহজে বুঝে নিই:

টেস্টের ধরন

নরমাল বা স্বাভাবিক মাত্রা

প্রি-ডায়াবেটিস অবস্থা

ডায়াবেটিস হিসেবে গণ্য

খালি পেটে (FBS)

৭০–৯৯ mg/dL

১০০–১২৫ mg/dL

≥ ১২৬ mg/dL

খাবার ২ ঘণ্টা পর (PPBS)

< ১৪০ mg/dL

১৪০–১৯৯ mg/dL

≥ ২০০ mg/dL

HbA1c

< ৫.৭%

৫.৭%–৬.৪%

≥ ৬.৫%

ডায়াবেটিস নির্ণয়: কখন বুঝবেন আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন?

ডায়াবেটিস প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারলে এর জটিলতাগুলো অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। তাই কিছু লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষা করানো বুদ্ধিমানের কাজ।

ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল খালি পেটে সুগার লেভেল নির্ণয় চিকিৎসা ও প্রতিরোধ গাইডdiabetes-sugar-level-normal-guide-bangla (1)
যদি আপনার মধ্যে ডায়াবেটিসের কোনো সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দেয়, তবে দেরি না করে পরীক্ষা করানো উচিত।

১. ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য সাধারণ পরীক্ষা কোনগুলো?

ডায়াবেটিস সঠিকভাবে শনাক্ত করতে চিকিৎসকেরা সাধারণত নিচের পরীক্ষাগুলো করার পরামর্শ দেন:

  • FBS (Fasting Blood Sugar): খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা।
  • PPBS (Postprandial Blood Sugar): খাবার ২ ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার মাত্রা।
  • HbA1c Test: গত তিন মাসের গড় রক্তে শর্করার মাত্রা।
  • Random Blood Sugar (RBS): দিনের যেকোনো সময় রক্তে শর্করার মাত্রা।

যদি আপনার মধ্যে ডায়াবেটিসের কোনো সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দেয়, তবে দেরি না করে এই পরীক্ষাগুলো করানো উচিত।

২. ঘরে বসে ডায়াবেটিস নির্ণয়ের সহজ উপায় আছে কি?

হ্যাঁ, আজকাল ঘরে বসেই গ্লুকোমিটার নামক ছোট একটি যন্ত্রের সাহায্যে রক্তে শর্করার মাত্রা মাপা যায়। এটি বেশ সুবিধাজনক, তবে মনে রাখবেন, যন্ত্র থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের সঠিকতা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে ভালো। ল্যাবরেটরিতে করা পরীক্ষাই সবসময় বেশি নির্ভরযোগ্য।

ডায়াবেটিসের বিভিন্ন ধরন ও সেগুলোর প্রভাব আমাদের শরীরে

ডায়াবেটিস প্রধানত কয়েক ধরনের হয়ে থাকে, এবং প্রতিটি ধরনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব রয়েছে।

ক. টাইপ ১ ডায়াবেটিস – একটি অটোইমিউন সমস্যা

এই ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত শিশু ও কিশোর বয়সে দেখা যায়, তবে যেকোনো বয়সেই হতে পারে। এক্ষেত্রে, আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে, শরীর আর ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না এবং রোগীকে জীবনধারণের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়।

খ. টাইপ ২ ডায়াবেটিস – ইনসুলিন প্রতিরোধ ও জীবনযাত্রার প্রভাব

এটি সবচেয়ে সাধারণ প্রকৃতির ডায়াবেটিস এবং প্রধানত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়, যদিও আজকাল অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে তরুণদের মধ্যেও এর প্রকোপ বাড়ছে। এক্ষেত্রে শরীর হয়তো পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, অথবা উৎপাদিত ইনসুলিন শরীর সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না (যাকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বলে)। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে ওষুধের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

গ. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes) – মায়েদের জন্য বিশেষ সতর্কতা

কিছু ক্ষেত্রে, গর্ভাবস্থায় মায়েদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। এটি মা এবং গর্ভের শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবে আশার কথা হলো, সন্তান প্রসবের পর এটি সাধারণত সেরে যায়, কিন্তু পরবর্তীতে মায়ের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

ঘ. প্রি-ডায়াবেটিস – বিপদের আগাম সতর্কবার্তা

এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, কিন্তু ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মতো অতটাও বেশি নয়। প্রি-ডায়াবেটিসকে ডায়াবেটিসের একটি সতর্কবার্তা বা ‘রেড অ্যালার্ট’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই পর্যায়ে জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন (যেমন – স্বাস্থ্যকর খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম) আনতে পারলে পূর্ণাঙ্গ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।

ডায়াবেটিসের সাধারণ লক্ষণগুলো কী কী? জেনে নিন প্রাথমিক উপসর্গ

ডায়াবেটিসের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা দেখলে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত এবং দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। লক্ষণগুলো হলো:

  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া: বিশেষ করে রাতের বেলা।
  • অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক পিপাসা লাগা: বারবার গলা শুকিয়ে যাওয়া।
  • শরীরের ওজন কমে যাওয়া: সঠিক খাদ্যাভ্যাস সত্ত্বেও ওজন হ্রাস।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ: সামান্য কাজেই হাঁপিয়ে ওঠা বা সারাক্ষণ দুর্বল লাগা।
  • চোখে ঝাপসা দেখা: দৃষ্টিশক্তি সাময়িকভাবে কমে যাওয়া।
  • শরীরের কোনো ক্ষত শুকাতে বেশি সময় লাগা: ছোটখাটো কাটাছেঁড়াও সারতে চায় না।
  • ঘন ঘন ইনফেকশন বা সংক্রমণ হওয়া: বিশেষ করে ত্বক, মূত্রনালি বা মাড়িতে।

এই উপসর্গগুলো এক বা একাধিক দেখা দিলে দেরি না করে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো উচিত।

ডায়াবেটিসের বৈশিষ্ট্য ও দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা – কেন সতর্কতা জরুরি?

ডায়াবেটিস যদি দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তবে তা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। আসুন জেনে নিই প্রধান কিছু জটিলতা:

১. চোখের সমস্যা (Retinopathy)

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস চোখের রক্তনালীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা থেকে ‘ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি’ নামক রোগ হতে পারে। এর ফলে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, এমনকি অন্ধত্ব পর্যন্ত বরণ করতে হতে পারে।

২. কিডনির ক্ষতি (Nephropathy)

ডায়াবেটিস কিডনির ছাঁকনি প্রক্রিয়ার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে, যা ‘ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি’ নামে পরিচিত। সময়মতো চিকিৎসা না করালে এটি কিডনি ফেইলিউরের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

৩. স্নায়ুবিক সমস্যা (Neuropathy)

রক্তে অতিরিক্ত শর্করা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে (ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি)। এর ফলে হাত-পায়ে ঝিনঝিন করা, অবশভাব, জ্বালাপোড়া বা তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

৪. হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি

ডায়াবেটিস রোগীদের হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এটি রক্তনালীগুলোকে শক্ত করে ফেলে এবং উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কাও বাড়িয়ে তোলে।

১. খাদ্যাভ্যাসে স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন — কী খাবেন, আর কী এড়িয়ে চলবেন?

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সঠিক খাবার বেছে নেওয়া এবং ভুল খাবার থেকে দূরে থাকা—এই দুটি বিষয়ে সচেতন হলে রক্তে শর্করার মাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।

ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল খালি পেটে সুগার লেভেল নির্ণয় চিকিৎসা ও প্রতিরোধ গাইডdiabetes-sugar-level-normal-guide-bangla (1)
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে

যা খেতে পারেন:

  • পরিমিত পরিমাণে ফলমূল: যেমন আপেল, পেয়ারা, জাম।
  • আঁশযুক্ত শাকসবজি: যেমন পালং শাক, করলা, লাউ।
  • কম কার্বযুক্ত শস্য: যেমন ব্রাউন রাইস, ওটস, চিড়া।
  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: ডাল, মাছ, মুরগি (চামড়াবিহীন), ডিমের সাদা অংশ।
  • পর্যাপ্ত পানি: প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।

যা এড়িয়ে চলা উচিত:

  • মিষ্টি জাতীয় খাবার ও পানীয়: যেমন মিষ্টি, চিনি, সফট ড্রিংকস।
  • পরিশোধিত শস্য: সাদা চাল, ময়দা।
  • ফাস্ট ফুড ও অতিরিক্ত তেল-মসলা যুক্ত খাবার।
  • ট্রান্সফ্যাট বা ডিপ ফ্রাইড খাবার।

২. নিয়মিত ব্যায়াম — সুগার কমাতে প্রাকৃতিক উপায়

শরীরচর্চা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে একটি প্রাকৃতিক এবং কার্যকর পন্থা। নিয়মিত ব্যায়ামে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস পায়।

যেসব ব্যায়াম উপকারী:

  • হাঁটা: প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা খুব উপকারী।
  • সাইক্লিং: নিয়মিত সাইকেল চালালে ক্যালরি খরচ হয় এবং সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
  • হালকা যোগব্যায়াম: মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে।

৩. ওষুধ বা ইনসুলিন — চিকিৎসকের পরামর্শে গ্রহণ করুন

যদি শুধু ডায়েট ও ব্যায়ামে সুগার নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ অথবা ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। নিজে থেকে কোনো ওষুধ শুরু বা বন্ধ করা উচিত নয়।

  • টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশন বাধ্যতামূলক।
  • টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ওষুধ, ইনসুলিন বা দুটোই লাগতে পারে।
  • নিয়মিত ব্লাড সুগার টেস্ট করে চিকিৎসক অনুযায়ী ডোজ ঠিক করতে হবে।

৪. মানসিক চাপ কমানো — সুগার বাড়ার অদৃশ্য কারণ

দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ রক্তে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ইনসুলিনের কার্যকারিতা হ্রাস করে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়।

চাপ কমানোর কিছু কৌশল:

  • প্রতিদিন কিছুক্ষণ ধ্যান বা প্রার্থনা।
  • পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো।
  • শখের কাজ যেমন বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি।

৫. পর্যাপ্ত ঘুম — সুস্থ ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্টের অংশ

ঘুমের অভাব শরীরের হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, ফলে ইনসুলিন প্রতিক্রিয়া কমে যায়। দিনে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ও নিরবিচারে ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।

প্রাকৃতিক প্রতিকার ও ঘরোয়া টিপস — নিয়মিত অভ্যাস গড়ে তুলুন

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান ও ঘরোয়া পদ্ধতি উপকারী হতে পারে। তবে এগুলোর কার্যকারিতা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে, এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়।

কিছু কার্যকর ঘরোয়া উপাদান:

  • করলা রস: প্রতিদিন সকালে এক কাপ করলা রস খাওয়া উপকারী হতে পারে।
  • মেথি বীজ ভেজানো পানি: সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে পান করলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমতে পারে।
  • আমলকি ও হরিতকী: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক।
  • দারুচিনি গুঁড়া: হালকা গরম পানির সঙ্গে সামান্য দারুচিনি গুঁড়া মিশিয়ে পান করা যেতে পারে।

কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি?

ডায়াবেটিস অনেক সময় নীরবে শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাই নিচের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি:

  • ঘন ঘন প্রস্রাব ও অতিরিক্ত পিপাসা।
  • হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া।
  • চর্মরোগ, ইনফেকশন বারবার হওয়া।
  • ক্ষত শুকাতে দীর্ঘ সময় লাগা।
  • চোখে ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়া।

উপসংহার: সচেতনতাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধের প্রথম ধাপ

ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সুষম খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ—এইসব কিছুর সমন্বয়ে আপনি একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার স্বাস্থ্য আপনারই হাতে, আর "প্রতিরোধই উত্তম চিকিৎসা"। তাই জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনুন, সচেতন হোন এবং সুস্থ থাকুন।

FAQ: ডায়াবেটিস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১: ফাস্টিং ব্লাড সুগার (খালি পেটে) কত হলে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে?

উত্তর: খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা যদি পরপর দুইবার বা তার বেশি ১২৬ mg/dL বা তার উপরে থাকে, তবে সাধারণত ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।

প্রশ্ন ২: প্রি-ডায়াবেটিস বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: প্রি-ডায়াবেটিস হলো এমন একটি অবস্থা যখন আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি (যেমন, খালি পেটে ১০০-১২৫ mg/dL), কিন্তু ডায়াবেটিস হিসেবে শনাক্ত হওয়ার মতো যথেষ্ট নয়। এটি ডায়াবেটিসের পূর্ব লক্ষণ।

প্রশ্ন ৩: HbA1c কত হলে ডায়াবেটিস হিসেবে গণ্য করা হয়?

উত্তর: HbA1c পরীক্ষার ফলাফল ৬.৫% বা তার বেশি হলে সাধারণত ডায়াবেটিস হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রশ্ন ৪: রক্তে সুগারের মাত্রা কত হলে তা বিপদজনক হতে পারে?

উত্তর: রক্তে সুগারের মাত্রা যদি হঠাৎ করে খুব কমে যায় (হাইপোগ্লাইসেমিয়া, সাধারণত ৭০ mg/dL এর নিচে) অথবা খুব বেড়ে যায় (হাইপারগ্লাইসেমিয়া, যেমন ৩৫০ mg/dL বা তার বেশি) এবং সাথে অন্যান্য উপসর্গ থাকে, তবে তা বিপদজনক হতে পারে এবং জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন।

প্রশ্ন ৫: ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কী কী?

উত্তর: ডায়াবেটিসের কিছু সাধারণ প্রাথমিক লক্ষণের মধ্যে রয়েছে – ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, অতিরিক্ত পিপাসা লাগা, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, খুব বেশি ক্লান্তি বোধ করা, চোখে ঝাপসা দেখা এবং শরীরের কোনো ক্ষত শুকাতে বেশি সময় লাগা।



Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)