গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে করণীয়: কারণ, ঝুঁকি, প্রতিকার ও পরামর্শ

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
By -
0
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে করণীয়: কারণ, ঝুঁকি, প্রতিকার ও পরামর্শgorbhabosthay-diabetes-karonio
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এটি শুধুমাত্র মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং গর্ভের শিশুর জন্যও বিভিন্ন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে

গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এই সময়টায় মায়ের শরীর ও মনে আসে নানা পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের মধ্যে কিছু শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে, যার মধ্যে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস অন্যতম। এটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেসটেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস (Gestational Diabetes Mellitus - GDM) নামেও পরিচিত। যখন গর্ভাবস্থায় প্রথমবার কোনো নারীর রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, তখন তাকে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বলা হয়।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এটি শুধুমাত্র মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং গর্ভের শিশুর জন্যও বিভিন্ন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ নারী গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এর হার কম নয়। এটি একটি নীরব ঘাতক হতে পারে, যা সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, এর কারণ, লক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং সুস্থ মা ও শিশুর জন্য করণীয় সম্পর্কে জানব।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কেন হয়?

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান:

  • হরমোনাল পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা (গর্ভফুল) থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলো ইনসুলিনের কার্যকারিতায় বাধা সৃষ্টি করে। এই অবস্থাকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি করে এই রেজিস্ট্যান্সকে সামলে নেয়, কিন্তু যখন অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, তখন রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় এবং গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
  • ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স: আগেই বলা হয়েছে, গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পায়। এটি শরীরের কোষগুলোর ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়।
  • পারিবারিক ইতিহাস, ওজন, বয়স: যাদের পরিবারের ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে, তাদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতাও একটি বড় ঝুঁকি। এছাড়া, ৩০ বছরের বেশি বয়সী গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও এই ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পূর্বে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল এমন নারীদের পরবর্তী গর্ভধারণেও এর পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি থাকে। ডায়াবেটিস কী ও ডায়াবেটিস কেন হয় এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস এর লক্ষণ

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো প্রায়শই মৃদু হয় এবং অনেক সময় তা স্পষ্ট নাও হতে পারে। কিছু নারীর ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণই দেখা যায় না, তাই নিয়মিত পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:

  • অতিরিক্ত পিপাসা: সাধারণের চেয়ে বেশি তৃষ্ণা অনুভব করা।
  • ঘন ঘন প্রস্রাব: বিশেষ করে রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
  • ক্লান্তিভাব: পর্যাপ্ত বিশ্রাম সত্ত্বেও অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা।
  • চোখ ঝাপসা দেখা: দৃষ্টিশক্তি সাময়িকভাবে ঝাপসা হয়ে যাওয়া।
  • ত্বকের সংক্রমণ: বারবার ত্বক বা যোনিতে ইস্ট সংক্রমণ (ইস্ট ইনফেকশন) হওয়া।
  • ক্ষুধা বৃদ্ধি: স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্ষুধা অনুভব করা। এসব লক্ষণ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে ডায়াবেটিসের লক্ষণ কী কী? জানুন বিস্তারিত গাইড ও প্রতিকার পড়ুন।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কত থাকলে নরমাল?

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রক্তে শর্করার নির্দিষ্ট মাত্রা জানা জরুরি। সাধারণত, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT) করা হয়। তবে সাধারণ কিছু রক্ত পরীক্ষা যেমন:

  • FBS (Fasting Blood Sugar): খালি পেটে রক্তে শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা ৯৫ mg/dL (৫.৩ mmol/L) এর নিচে থাকা উচিত। এর বেশি হলে ডায়াবেটিস নির্দেশ করে।
  • PPBS (২ ঘণ্টা পর খাবার পর): খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা ১২০ mg/dL (৬.৭ mmol/L) এর নিচে থাকা উচিত।
  • HbA1c স্তরের গ্রহণযোগ্য মাত্রা: HbA1c গ্লুকোজের সাথে হিমোগ্লোবিনের সংযুক্তির পরিমাণ পরিমাপ করে, যা গত ২-৩ মাসের গড় রক্তে শর্করার মাত্রা নির্দেশ করে। গর্ভাবস্থায় এর মাত্রা ৬.০% এর নিচে রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে HbA1c শুধুমাত্র ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য প্রধান পরীক্ষা নয়, বরং এটি নিয়ন্ত্রণের একটি পরিমাপক।

এই মাত্রাগুলো একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নির্ণয় করবেন এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসার নির্দেশনা দেবেন। ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল? খালি পেটে সুগার লেভেল নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ গাইড আর্টিকেলে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য পাবেন।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কত থাকলে ইনসুলিন নিতে হয়?

যখন খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, তখন চিকিৎসকরা ইনসুলিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

  • ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কখন: সাধারণত, যদি খালি পেটে শর্করার মাত্রা ৯৫-১০০ mg/dL এর বেশি হয় এবং খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর শর্করার মাত্রা ১২০-১৪০ mg/dL এর বেশি থাকে, তখন ইনসুলিন শুরু করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে এটি চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এবং রোগীর সার্বিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে থেরাপি শুরু: ইনসুলিন থেরাপি কখনোই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া শুরু করা উচিত নয়। চিকিৎসক রোগীর ওজন, রক্তে শর্করার মাত্রা, এবং গর্ভাবস্থার পর্যায় বিবেচনা করে ইনসুলিনের ডোজ নির্ধারণ করেন।
  • ইনসুলিন না নিলে সম্ভাব্য ঝুঁকি: ইনসুলিন না নিলে রক্তে শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাকতে পারে, যা মা ও শিশু উভয়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি, অতিরিক্ত ওজন, শ্বাসকষ্ট, এবং জন্মের পর হাইপোগ্লাইসেমিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। মায়ের ক্ষেত্রে প্রি-এক্লাম্পসিয়া, সি-সেকশনের ঝুঁকি এবং ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে করণীয়: কারণ, ঝুঁকি, প্রতিকার ও পরামর্শgorbhabosthay-diabetes-karonio
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত বিরতিতে রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করা জরুরি।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে করণীয়

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয় হলে ঘাবড়ে না গিয়ে কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক:

  • নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত বিরতিতে রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করা জরুরি। এটি আপনাকে এবং আপনার ডাক্তারকে আপনার ডায়াবেটিস কতটা নিয়ন্ত্রণে আছে তা বুঝতে সাহায্য করবে।
  • বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ: একজন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট বা গাইনোকোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে থাকা অপরিহার্য। তারা আপনার স্বাস্থ্য অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা তৈরি করবেন।
  • খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পরিবর্তন: এটি গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তি। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • ইনসুলিন বা ওষুধ প্রয়োগ: যদি খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে চিকিৎসক ইনসুলিন ইনজেকশন বা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের পরামর্শ দিতে পারেন। ডায়াবেটিস এর লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার: বিস্তারিত গাইড এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনযাত্রার পরিবর্তন অত্যন্ত কার্যকর:

  • কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার: কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) যুক্ত খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ায়। যেমন: গোটা শস্য, শিম, ডাল, শাকসবজি এবং নির্দিষ্ট কিছু ফল।
  • সময়মতো খাবার খাওয়া: ছোট ছোট ভাগে ঘন ঘন খাবার খাওয়া উচিত, যা রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। খাবার বাদ দেওয়া উচিত নয়।
  • হালকা ব্যায়াম ও হাঁটা: নিয়মিত হালকা ব্যায়াম যেমন: ৩০ মিনিটের হাঁটা বা যোগা গ্লুকোজের ব্যবহার বাড়াতে সাহায্য করে। তবে যেকোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম: পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম শরীরের হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা ইনসুলিনের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। এছাড়া, মনের প্রশান্তির জন্য কিছু সহজ অভ্যাস আপনার মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর উপায় (প্রাকৃতিক উপায় সহ)

যদিও প্রাকৃতিক উপায়গুলো শুধুমাত্র চিকিৎসার বিকল্প হতে পারে না, তবে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে:

  • করলা, মেথি, দারচিনি: এই উপাদানগুলো ঐতিহ্যগতভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
  • করলা: করলার রস বা তরকারি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তবে গর্ভাবস্থায় এটি সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • মেথি: মেথি দানা বা মেথির জল ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
  • দারচিনি: দারচিনিও রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, পরিমিত পরিমাণে সেবন করা উচিত।
  • প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদান যা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়: ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, যেমন - ওটস, বার্লি, শিম, ডাল, এবং শাকসবজি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারও রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কি কি খাওয়া যাবে না?

রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু খাবার সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা উচিত:

  • চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার: মিষ্টি, কেক, বিস্কুট, আইসক্রিম, চকোলেট ইত্যাদি চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
  • সাদা ভাত, ময়দা জাতীয় খাবার: সাদা ভাত, সাদা রুটি, পরোটা, লুচি, পাউরুটি, নুডুলস, পাস্তা এবং অন্যান্য ময়দা জাতীয় খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। এর পরিবর্তে লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, ওটস ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার ও সফট ড্রিংকস: প্রক্রিয়াজাত মাংস, চিপস, ফাস্ট ফুড এবং চিনিযুক্ত সফট ড্রিংকস যেমন - কোলা, সোডা ইত্যাদি পরিহার করা উচিত। আরও বিস্তারিত জানতে ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা: সুস্থ থাকতে যা এড়িয়ে চলবেন এই আর্টিকেলটি পড়ুন।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে করণীয়: কারণ, ঝুঁকি, প্রতিকার ও পরামর্শgorbhabosthay-diabetes-karonio

কিছু ফলে উচ্চ পরিমাণে প্রাকৃতিক শর্করা থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কি কি ফল খাওয়া যাবে না?

কিছু ফলে উচ্চ পরিমাণে প্রাকৃতিক শর্করা থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে। এগুলি সীমিত পরিমাণে বা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা উচিত:

  • আঙুর: আঙুরে শর্করার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।
  • কলা: পাকা কলায় উচ্চ পরিমাণে শর্করা থাকে।
  • কাঁঠাল, লিচু: এই ফলগুলোতেও শর্করার পরিমাণ বেশি।
  • আম: পাকা আমে প্রচুর শর্করা থাকে, তাই এটিও পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কি কি ফল খাওয়া যাবে?

কিছু ফল রয়েছে যেগুলোতে শর্করা কম থাকে এবং ফাইবার বেশি থাকে, যা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী:

  • আপেল: আপেল ফাইবারে ভরপুর এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • কমলা: কমলায় ভিটামিন সি এবং ফাইবার থাকে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো।
  • পেয়ারা: পেয়ারাও ফাইবারে সমৃদ্ধ এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
  • স্ট্রবেরি, জাম: বেরি জাতীয় ফল যেমন স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, এবং জাম কম শর্করাযুক্ত এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ডায়েট চার্ট (সপ্তাহভিত্তিক পরিকল্পনা)

একটি সুষম ডায়েট চার্ট গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটি সাধারণ সপ্তাহভিত্তিক পরিকল্পনা দেওয়া হলো, তবে এটি অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কাস্টমাইজ করা উচিত:

সকাল:

  • লাল আটার রুটি (১-২টি) বা ওটস (১ বাটি)
  • ডিম (১টি সিদ্ধ/পোচ) বা পাতলা ডাল
  • এক মুঠো অঙ্কুরিত ছোলা বা শসা/গাজর

হালকা স্ন্যাকস (সকাল ১০-১১টা):

  • ১টি আপেল বা পেয়ারা
  • মুঠো শসা/গাজর

দুপুর:

  • লাল চালের ভাত (১ কাপ) বা লাল আটার রুটি (১টি)
  • মাছ/মুরগি (১-২ টুকরা) বা ডাল
  • সবজি (১ বাটি, তেল কম দিয়ে রান্না করা)
  • সালাদ (শসা, টমেটো)

হালকা স্ন্যাকস (বিকাল ৪-৫টা):

  • ২-৩টি বিস্কুট (ডায়াবেটিক ফ্রেন্ডলি) বা এক মুঠো বাদাম (চিনাবাদাম বা কাঠবাদাম)
  • এক কাপ টক দই

রাত:

  • লাল চালের ভাত (১ কাপ) বা লাল আটার রুটি (১টি)
  • মাছ/মুরগি (১-২ টুকরা) বা ডাল
  • সবজি (১ বাটি)

শুতে যাওয়ার আগে (প্রয়োজনে):

  • এক গ্লাস ফ্যাট-ফ্রি দুধ বা এক মুঠো বাদাম

কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফাইবার ও চর্বির সুষম ব্যালান্স: খাবারের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফাইবার এবং স্বাস্থ্যকর চর্বির সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, যেমন - গোটা শস্য, প্রচুর ফাইবার, এবং পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে বাচ্চার কি ক্ষতি হয়?

গর্ভাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস মা ও শিশু উভয়ের জন্যেই বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে:

  • ওজন বেশি বা কম জন্মানো: অনিয়ন্ত্রিত রক্তে শর্করার কারণে শিশু অস্বাভাবিকভাবে বড় হতে পারে (ম্যাক্রোসোমিয়া), যা জন্মদানে জটিলতা সৃষ্টি করে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে শিশুর ওজন কমও হতে পারে।
  • প্রি-ম্যাচিউর ডেলিভারি: ডায়াবেটিস থাকলে সময়ের আগে প্রসব হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  • বাচ্চার জন্মের পর হাইপোগ্লাইসেমিয়া ঝুঁকি: মায়ের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে শিশুর শরীরে অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি হয়। জন্মের পর যখন শিশু মায়ের উচ্চ গ্লুকোজ সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন তার রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ কমে যেতে পারে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)।
  • ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা: যেসব শিশুর মায়েদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ছিল, তাদের ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • শ্বাসকষ্টের সমস্যা: ফুসফুসের কার্যকারিতা বিকাশে বিলম্ব হতে পারে।
  • জন্মগত ত্রুটি: কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি যেমন: হৃদপিণ্ডের সমস্যা বা স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ডায়াবেটিস হলে বাচ্চা নেওয়ার উপায় (নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য)

ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও সুস্থ সন্তান ধারণ করা সম্ভব, তবে এর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি:

  • প্রি-কনসেপশন কাউন্সেলিং: সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করার আগে ডাক্তার এবং ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত। তারা আপনার বর্তমান স্বাস্থ্য অবস্থা মূল্যায়ন করবেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।
  • ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা: সন্তান ধারণের আগে এবং গর্ভাবস্থার পুরো সময়জুড়ে রক্তে শর্করার মাত্রা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এর ফলে জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি কমে এবং গর্ভকালীন জটিলতা এড়ানো যায়।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক জীবনধারা: স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এবং সুস্থ গর্ভাবস্থার জন্য সহায়ক। ধূমপান এবং মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকাআত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ৭টি কার্যকর কৌশল এই সময়ে আপনার সামগ্রিক সুস্থতার জন্য সহায়ক হতে পারে।

পুরুষের ডায়াবেটিস হলে কি সন্তান হয়?

পুরুষদের ডায়াবেটিস সন্তান ধারণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত রক্তে শর্করার মাত্রা শুক্রাণুর স্বাস্থ্য এবং কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

  • স্পার্মের গুণগত মানে প্রভাব: ডায়াবেটিস শুক্রাণুর সংখ্যা, গতিশীলতা এবং ডিএনএ অখণ্ডতাকে প্রভাবিত করতে পারে, যা গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
  • টেস্টোস্টেরন হ্রাস: ডায়াবেটিস পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা হ্রাস করতে পারে, যা যৌন স্বাস্থ্য এবং শুক্রাণু উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • যৌন সক্ষমতা ও সন্তানধারণে সমস্যা: পুরুষদের ডায়াবেটিসের কারণে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (উত্থানজনিত সমস্যা) দেখা দিতে পারে, যা স্বাভাবিক যৌন জীবন এবং সন্তান ধারণে বাধা সৃষ্টি করে।

পুরুষের ডায়াবেটিস হলে বাচ্চা নেওয়ার উপায়

পুরুষদের ক্ষেত্রেও সুস্থ সন্তান ধারণের জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য:

  • চিকিৎসকের পরামর্শ: একজন ইউরোলজিস্ট বা এন্ডোক্রিনোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করা উচিত। তারা শুক্রাণুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।
  • ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা: রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা শুক্রাণুর গুণগত মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম: পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্য, হরমোন ভারসাম্য এবং শুক্রাণুর উৎপাদনকে উন্নত করতে সাহায্য করে।

করণীয় সারসংক্ষেপ (Checklist)

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করুন:

  • রেগুলার চেকআপ: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করান।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্য: পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একটি সুষম এবং ডায়াবেটিস-বান্ধব খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন।
  • ইনসুলিন বা ওষুধ প্রয়োগ: যদি প্রয়োজন হয়, চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ইনসুলিন বা অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করুন।
  • ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা: যেকোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা বা প্রশ্নের জন্য দেরি না করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং তাদের পরামর্শ মেনে চলুন।

উপসংহার

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণীত হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং জীবনযাত্রার সঠিক পরিবর্তন দ্বারা এটি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চললে মা এবং শিশু উভয়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা যায়। মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণই এই যাত্রাটি নিরাপদ এবং আনন্দময় করতে সাহায্য করবে। সুস্থ মা মানেই সুস্থ শিশু, আর এই সুস্থতার ভিত্তি স্থাপন হয় সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)

১. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কি সিজার হয়?

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে সিজারিয়ান সেকশনের ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়, বিশেষ করে যদি শিশু বড় হয় (ম্যাক্রোসোমিয়া) বা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকে। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়। অনেক ক্ষেত্রে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণে স্বাভাবিক প্রসবও সম্ভব।

২. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসে ফল খাওয়া নিরাপদ কি না?

হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসে ফল খাওয়া নিরাপদ, তবে সব ফল নয় এবং পরিমিত পরিমাণে। কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত ফল যেমন আপেল, কমলা, পেয়ারা, স্ট্রবেরি, জাম ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। উচ্চ শর্করাযুক্ত ফল যেমন আঙুর, কলা, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি সীমিত পরিমাণে বা এড়িয়ে চলাই ভালো।

৩. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কি গর্ভপাত ঘটাতে পারে?

গর্ভাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে। রক্তে শর্করার উচ্চ মাত্রা ভ্রূণের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়ায়, যা গর্ভপাতের কারণ হতে পারে।

৪. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়?

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রধানত তিনটি উপায় আছে: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার, সময়মতো খাবার), নিয়মিত হালকা ব্যায়াম (যেমন হাঁটা), এবং প্রয়োজন অনুসারে ইনসুলিন বা ওষুধের ব্যবহার। চিকিৎসকের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে থাকা অপরিহার্য।

৫. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কি জন্মের পর চলে যায়?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস শিশুর জন্মের পর (সাধারণত ৬ সপ্তাহের মধ্যে) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে, যাদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ছিল, তাদের ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই ডেলিভারির পরও নিয়মিত চেকআপ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন মেনে চলা উচিত।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)